ব্লগ

দেশের অন্য নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে পাল্লা দিতে ইট শিল্পেরও বিবর্তন প্রয়োজন

Anand Damle | মঙ্গলবার 18 সেপ্টেম্বর 2018

পাঁচ হাজার বছর আগে আবিষ্কৃত হওয়ার পরে মাটির ইট তৈরির শিল্পই একমাত্র মানুষের হাতের কাজের শিল্প যা এখনও টিকে আছে। প্রযুক্তিগত ভাবে ওই শিল্প ভারী মাটির শিল্প বা সিরামিক শিল্পের আওতায় পড়ে। ভারী মাটির শিল্প এমনই একটা শিল্প যেখানে মাটির সঙ্গে কোনও খাদ মেশানো হয় না। ইট, ঝামা, ফাঁপা মাটির ব্লক, ছাদের টালি, অন্য টালি-এই ধরনের শিল্পের অন্তর্গত।

ইট তৈরির ক্ষেত্রে ভারত কিন্তু পথিকৃত। পৃথিবীর প্রথম ইটভাটাটি তৈরি হয়েছিল প্রাচীন ভারতের কালিবানগান শহরে। বর্তমানে তা রাজস্থানে। সিন্ধু সভ্যতার সময়কার (খ্রীষ্টপূর্ব 3000 সাল) নানা প্রত্নতত্ত্বের মধ্যে ইটের দেওয়ালের সন্ধান মিলেছে। তার আগেও যে রাজস্থানের কালিবানগানে ইট তৈরি হয়েছে তার প্রমাণ মিলেছে।

 

দেওয়াল গাঁথায় ইটের ব্যবহার 

দেওয়াল গাঁথার সামগ্রী হিসেবে প্রাচীন কাল থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে ইট। এই কাজে ইটের বিকল্প কিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন সামগ্রী লুপ্ত হয়ে গেলেও দেওয়াল গাঁথায় তার প্রয়োজনীয়তা না কমায় ইটের ব্যবহার বেড়েছে বই কমেনি। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইটের গঠন বদলেছে। এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে কংক্রিটের ব্লক, ক্যালসিয়াম সিলিকেটের ইট, এএসি ব্লক, সিএলসি ব্লক, ফ্লাই অ্যাশের তৈরি ইট বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কিন্তু ভাটায় তৈরি মাটির ইট দিব্যি টিকে আছে।

এই যুগেও সামগ্রিক ভাবে শতকরা 75 থেকে 80 শতাংশ দেওয়াল কিন্তু তৈরি হয় ইট দিয়েই। তবে অন্য ধরনের স্ল্যাব এবং কক্রিটের স্ল্যাবের ব্যবহার কিন্তু দিনকে দিন বাড়ছে। বিশেষ করে শহর এলাকায় দেওয়াল তৈরির সামগ্রী হিসেবে ভাটায় তৈরি ইটের ব্যবহার কমে দাঁড়িয়েছে শতকরা 50 শতাংশ। বাকি 50 শতাংশের জায়গা নিয়েছে ইটের বিকল্প সামগ্রীগুলি।

 

ইটের বিকল্প সামগ্রী বাজারে এল কী ভাবে?

ষাটের দশকের আগে ভাটায় তৈরি ইটের ব্যবহারই ছিল একচেটিয়া। পশ্চিম ভারত ও দক্ষিণ ভারতে সেই সময়ে বাজারে আসে কংক্রিটের ইট। তারপরে বাজারে আসে এএসি ব্লক। কিন্তু তাদের বাজার ধরতে বছর কুড়ি সময় লেগেছিল। গত দশক থেকেই ইটের বিকল্প সামগ্রী ভাল বাজার পেতে শুরু করেছে। এর মূল কারণ হল সাবেক ইট ভাটা পুরনো পদ্ধতিতেই চলছিল। সময়ের সঙ্গে তারা প্রযুক্তি এবং মানের বদল ঘটায়নি। দীর্ঘদিন ধরে ইট ভাটার মালিকেরা সচেতন না হওয়ায় বিকল্প সামগ্রী বাজার ধরতে শুরু করে একটু একটু করে।

গৃহ নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শিল্পপতিদের প্রথম লক্ষ্য থাকে কোনও সামগ্রী বছরভর পাওয়া যাবে এবং সেই সামগ্রীর দাম যেন স্থিতিশীল থাকে। সাবেক ইটভাটার মালিকেরা বাজারের এই চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেননি। আরসিসি ইটের মান, দাম, বছরভর তার সরবরাহ, কম ওজন এবং কাঠিন্য ধীরে ধীরে তাকে বাজারে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু করে। সাবেক ইটভাটার মালিকেরা কখনও তাঁদের চিরাচরিত ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেননি। ফলে পড়ে পড়ে মার খেয়েছে সাবেক ইটভাটাগুলি।

 

ইট ভাটাগুলি এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করবে কী ভাবে?

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলাচ্ছে মানুষের রুচি। বদলাচ্ছে প্রয়োজনীয়তা। বাড়ি নির্মাণ শিল্প কোন সময়ে ঠিক কি চাইছে সেটা বুঝে ইট ভাটার মালিকদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে ইটের বিকল্প অন্য কিছু তৈরি করেও ইট ভাটার মালিকদের বাজার ধরে রাখতে হবে।

বাজারে গিয়ে প্রথমে ভাটা মালিকদের জানতে হবে তাঁদের ভাটায় তৈরি ইটের মান ও অন্য গুণাগুন সম্পর্কে মানুষ কী বলছে। প্রয়োজনে ক্রেতাদের কাছে দ্রুত পৌঁছে যেতে হবে। নিতে হবে নতুন কোনও বিপনণ কৌশল। ওয়েনারবার্গার যেমন ‘মাটির সঙ্গে থাকুন’ এই স্লোগান দিয়েই বাজারে প্রভাব ফেলেছিলেন, তেমন কোনও স্লোগানের কথাও ভাবতে হবে ইট ভাটার মালিকদের। শুধু নিজের গ্রাম স্তরে নয়, ব্লক স্তরে, জেলা স্তরে, রাজ্য স্তরে এমনকী জাতীয় স্তরে ভাটা মালিকদের সংগঠনের মধ্যে নিবিড় যোগাযোগ তৈরি করতে হবে। সবার থেকে তথ্য নিয়ে বাজার কী চায় সেই সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তৈরি করতে হবে। কী ভাবে নিজেদের বদলানো যায় তা নিয়ে জাতীয় স্তরে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মাটির ইটের গ্রহণযোগ্যতা বোঝাতে ক্রেতাদের কাছে গিয়ে কিংবা সভা করে, আলোচনাচক্রের আয়োজন করে, সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং গবেষণাপত্রে বলতে হবে যে এই ইট কতটা সস্তা এবং পরিবেশ বান্ধব।

এর পাশাপাশি ভাটাগুলির অভ্যন্তরীন কিছু পরিবর্তনও জরুরি। পেশাদার প্রশাসক যেমন বসাতে হবে তেমনই সারা বছর কী ভাবে ইটের উৎপাদন অব্যাহত রাখতে নতুন প্রযুক্তি ও আনতে হবে। ভাটার মালিকদের বুঝতে হবে যে মাটির সঙ্গে কৃষিজাত, শিল্পজাত কিংবা গৃহজাত বিভিন্ন দাহ্য বর্জ্য পদার্থ মেশালে সেই ইট অনেক হালকা হবে এবং ইটের মধ্যে অসংখ্য ছিদ্র তৈরি হবে। মহারাষ্ট্র এবং উপকূলবর্তী অন্ধ্রপ্রদেশের ভাটাগুলির ক্ষেত্রে এই ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার খুবই কার্যকর হবে। ইট নির্মাতাদের আরও নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের বিষয়টি দেখতে হবে। ফাঁপা ইটের উৎপাদন কী ভাবে আরও বাড়ানো যায় দেখতে হবে সেটাও। দেওয়াল তৈরির কাজে ওই ফাঁপা ইট আরও উপযোগী।

ইট নির্মাতাদের আরও নতুন নতুন পথে চলার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ভাটা মালিকদের এ ব্যাপারে তেমন উদ্যোগী হতে দেখা যায়নি। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ তেমন দৃঢ় না হওয়াতেই এককাট্টা হয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না ইট নির্মাতারা। বাড়ি নির্মাতা ইটের বদলে অন্য সামগ্রী ব্যবহার করতে শুরু করায়, অনেক ভাটা মালিকেরই দিশেহারা অবস্থা। নিজেদের বাঁচানোর যতো তাড়াতাড়ি যুগের সঙ্গে পা মিলিয়ে ভাটামালিকেরা প্রযুক্তি বদল করবেন ততোই তাঁদের মঙ্গল। এ কী ভাবে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি মিলতে পারে তার পথ খুঁজে বের করতে হবে ভাটা মালিকদেরই।

Anand Damle

The writer is the Managing Director of
De Boer Damle (India) Pvt. Ltd. Pune

Advertisement

Advertisement

আরও ব্লগ জন্য এখানে ক্লিক করুন এখানে ক্লিক করুন দেশের অন্য নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে পাল্লা দিতে ইট শিল্পেরও বিবর্তন প্রয়োজন মেইন পেজে যাওয়ার জন্যClick here to go to User Home